Header Ads

টর (TOR)- ইন্টারনেটে নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার সর্বোচ্চ মাধ্যম

 


প্রতিটি মানুষই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কমবেশি সচেতন থাকে। নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দিলে আমরা যতটা সম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করি, যাতে নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের মতো আমাদের ভার্চুয়াল জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও রয়েছে বেশ কিছু মাধ্যম। আমরা অনেকেই ভিপিএন সম্পর্কে জানি। অনেকেই আমরা ভার্চুয়াল জীবনের নিরাপত্তার জন্য ভিপিএন ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু ভিপিএন- এর চেয়েও অধিক শক্তিশালী, বেশি নিরাপত্তা প্রদানকারী ও গোপনীয়তা রক্ষাকারী মাধ্যম হচ্ছে টর নেটওয়ার্ক।

বিভিন্ন ডার্ক সাইটে নিজের পরিচয় গোপন রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও ইন্টারনেটে জগতে নিজের আইপি এড্রেস লুকিয়ে স্বাধীন ও নিরাপদভাবে ঘুরে বেড়ানোর অসাধারণ একটি মাধ্যম হচ্ছে টর ব্রাউজার। 

টর কী?

টর(TOR) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে  The Onion Router। ইংরেজি অনিয়ন শব্দের বাংলা অর্থ পেঁয়াজ। পেঁয়াজ যেমন কয়েক স্তরের পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে ঠিক তেমনিভাবে TOR- এ কমপক্ষে তিনটি স্তর থাকে। আর এই স্তরগুলোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে টর নামকরণ করার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর গবেষণাগারে তাদের  তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের ডাটা এনক্রিপ্টেড করার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে টর সফটওয়্যারের বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এসে ইন্টারনেটের জগতে ট্র্যাফিকের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য টর নেটওয়ার্কের কার্যক্রম শুরু হয়।

টর কীভাবে কাজ করে? 

টর নেটওয়ার্ক মূলত অনিয়ন রাউটিং প্রক্রিয়ায় তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। টর ব্রাউজারের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রিলে বা নোড থাকে। এই রিলে বা নোড হচ্ছে বিভিন্ন স্তর বা পথ যেগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যবহারকারীর ডাটা এনক্রিপ্টেড হয়ে থাকে। প্রথমে যখন একজন ব্যবহারকারী টর ব্রাউজারের মাধ্যমে কোনো সাইটের এড্রেসে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, তখন ব্যবহারকারীর আইপি অ্যাড্রেস ও ডাটা এন্ট্রি গার্ড রিলের মধ্যে প্রবেশ করে, এই স্তরে ডাটাগুলো এনক্রিপ্টেড হয়ে তারপর তা মিডল রিলেতে পৌঁছে যায়; এখানেও ডাটা এনক্রিপ্টেড হয়। তারপর ব্যবহারকারীর অ্যাড্রেস ও ডাটা চূড়ান্ত রিলে তথা এক্সিট রিলেতে পৌঁছে যায়। এই স্তরে এসে আর ডাটা এনক্রিপ্ট হয় না বরং আনএনক্রিপ্ট হয়ে ব্যবহারকারীকে গন্তব্য সাইটে পৌঁছে দেয়। ফলে এই স্তরে এসে ব্যবহারকারী ও গন্তব্য সাইটের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।

কিন্তু মাঝখানের এই ডাটা এনক্রিপ্টেডের ফলে ব্যবহারকারীর পরিচয় আর জানা সম্ভব হয় না। কারণ প্রতি স্তরেই ব্যবহারকারীর সার্ভার এড্রেস পরিবর্তিত হয়েছে এবং ডাটা এনক্রিপ্টেড হয়েছে। এতে টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর প্রকৃত ঠিকানার অস্তিত্ব আর বিদ্যমান থাকে না। এছাড়াও প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর টর নেটওয়ার্কের মধ্যবর্তী স্তরের বা পথের তথ্য পরিবর্তন হয়। আর এভাবেই টর নেটওয়ার্ক ইন্টারনেট জগতে তার ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।


টর ব্রাউজার কীভাবে ব্যবহার করবেন? 

উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্য মজিলা ফায়ারফক্সকে কাস্টমাইজ করে টর ব্রাউজার তৈরি করা হয়েছে। প্রথমেই এই সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে আপনার কম্পিউটার ডিভাইসে সেট করুন। তারপর এই ব্রাউজারের মাধ্যমে যেকোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার সময় আপনি টর নেটওয়ার্কের সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। স্মার্টফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্যও টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এজন্য অ্যাপের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি অধিক জনপ্রিয় অ্যাপ হচ্ছে অরবোট (Orbot) ও অরওয়েব (Orweb)। এ দুটি অ্যাপই গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যাবে। আপনি এ দুটি অ্যাপের মধ্য থেকে যেকোনো একটি ইনস্টল করে নিয়ে টর নেটওয়ার্ক এতে যুক্ত করতে পারবেন। টর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা জটিল কোনো বিষয় নয়। শুধুমাত্র সফটওয়্যার বা অ্যাপ ইন্সটল করতে পারলেই যথেষ্ট; তারপর সফটওয়্যার বা অ্যাপের মাধ্যমে আপনি সরাসরি টর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারবেন।


টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধা

টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের নানাবিধ সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি, তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য টর নেটওয়ার্ক ব্যবহার হয়ে থাকে। এক নজরে টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধাগুলো জেনে নিন।

১. টর নেটওয়ার্ক আপনি বিনামূল্যেই উপভোগ করতে পারবেন।

২. ডার্ক ওয়েব সাইটগুলোতে সহজেই ও নিরাপদে প্রবেশ করতে পারবেন।

৩. ভৌগোলিকভাবে ব্লক করা ওয়েব সাইটগুলোতে সহজেই প্রবেশাধিকারের সুযোগ পাবেন।

৪. হ্যাকিংয়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন।

৫. নিরাপদে তথ্য আদান প্রদান করতে সক্ষম হবেন।


টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের অসুবিধা

টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের নানাবিধ সুবিধা থাকলেও এটি ব্যবহারের কিছু অসুবিধাও বিদ্যমান আছে। যেমন:

১. এই নেটওয়ার্ক খুব ধীর গতিসম্পন্ন। আপনি কোনো সাইটে ঢুকতে চাইলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢুকতে পারবেন না, বরং আপনার অতিরিক্ত সময় অপচয় হবে।

২. এক্সিট নোডে বা রিলেতে ডাটা এনক্রিপ্টেড হয় না। ফলে এই স্তরে গিয়ে অনেক সময়ই তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না; এতে হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারেন।

৩. টর নেটওয়ার্ক যেহেতু বিনামূল্যে ব্যবহার উপযোগী এবং এটি স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে এটির মধ্যে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার ঘাটতি এবং ঝুঁকি পরিলক্ষিত হয়।

৪. অনেক সময়ই ডার্ক ওয়েবগুলোতে প্রবেশ করে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।

৫. যেহেতু টর ব্রাউজার ডাউনলোড করতে হয় ফলে ডাউনলোড করার সময়ই আপনার আইপি এড্রেস পাচার হতে পারে।

৬.  টর নেটওয়ার্ক মূলত তারাই ব্যবহার করে যারা অত্যন্ত সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। ফলে আপনি যদি টর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন তবে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে চিহ্নিত হতে পারেন।


ভিপিএন বনাম টর নেটওয়ার্ক

ভিপিএন ব্যবহারের সুবিধা বেশি নাকি টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধা বেশি? এ নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে। ভিপিএনও তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে ভিপিএন-এর মধ্যে কোনো স্তর নেই। ভিপিএন তৈরিকারী ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান আইপি অ্যাড্রেস পরিবর্তন ও ডাটা এনক্রিপ্ট করার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা প্রদান করে। এতে ব্যবহারকারী অনেক সময়ই ভিপিএন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়; এমনকি ঝুঁকির মধ্যেও থাকে। কিন্তু টর নেটওয়ার্কে কয়েকটি স্তরে ডাটা এনক্রিপটেড হওয়ার কারণে ব্যবহারকারীর সঠিক পরিচয় আর নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়। এদিক দিয়ে ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা অধিক নিশ্চিত হয়। এই দিক বিবেচনায় ভিপিএনের চেয়ে টর নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ভালো।


তবে টর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোনো সাইটে প্রবেশ করতে অধিক সময় ব্যয় হয় কিন্তু ভিপিএন ব্যবহারের ফলে ইন্টারনেটের গতি কমে যায় না। প্রকৃতপক্ষে ভিপিএন ও টর নেটওয়ার্ক উভয়েরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বিদ্যমান আছে। তবে সব দিক বিবেচনায় ও ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে টর নেটওয়ার্ক ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচিত হবে।    

আপনি টর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানতে পারলেন। ফলে টর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আপনার ধারনা পরিষ্কার হয়েছে বলে প্রত্যাশা করতেই পারি। এবার আপনি আপনার সুযোগ-সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনা পূর্বক টর নেটওয়ার্কের ইতিবাচক দিকগুলো উপভোগ করতে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.