Header Ads

নিকোলা টেসলাঃ কিংবদন্তী বিজ্ঞানীর আড়ালে থাকা অবদান

 


ধরুণ ড্রয়িং রুমের সুইচ বোর্ড দিয়ে টিউবলাইট জ্বালিয়ে টিভি দেখতে বসেছেন আপনি। এক চ্যানেল ভালো লাগছে না, মুহুর্তেই রিমোট টিপে বদলে ফেললেন সেটি, চলে গেলেন অন্য চ্যানেলে। মাঝে মধ্যে রেডিও শুনতেও মন্দ লাগেনা আপনার। চেষ্টা করেন আরজেদের মতো করে কথাও বলতে। তো আজ আপনার পছন্দের রেডিওতে ‘ভ্রমণ’ বিষয়ক কথা বলে যাচ্ছেন আরজে। তার কথা শুনে আপনারও মনে পড়ে গেল আপনি কিছু দিন আগেই কাপ্তাই হ্রদ আর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখে এসেছেন। সেখানে ঘুরতে গিয়ে আপনার এক বন্ধু অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনায় হাত ভেঙ্গে ফেলেছিল। সেই বন্ধুর ভাঙ্গা হাত এক্সরে করাতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে আপনাকে।


এই যে এত এত ঘটনার কথা বলে গেলাম- সুইচ বোর্ডের বিদ্যুৎ, টিউব লাইট, রিমোট, রোবোটিক্স, রেডিও, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এক্স-রে এসব কিছুর মূল কারিগর একজন বিজ্ঞানী।

চলুন একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। সাল ১৮৮৮। আমেরিকার নিউইউয়র্কের রাস্তায় মানুষজন দেখল এক অদ্ভুত ঘটনা। একটা কুকুরের সারা শরীরে পেঁচানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক তার। এরপর বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার সাথে সাথে অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়ে কুকুরটি মারা গেল। এই কাজটি যিনি করছেন তিনি মানুষজনকে বোঝাতে চাইছেন এসি (AC) কারেন্টের নেতিবাচক দিক। অর্থাৎ তারের মাধ্যমে প্রবাহিত বিদ্যুৎ কতটা বিপজ্জনক তাই বোঝাতে চাইছেন । যিনি এ কাজটি করছেন তাকে আমরা প্রায় সকলেই চিনি। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন!


এডিসন আরেক অসাধারণ বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার আবিষ্কৃত বিদ্যুতের কুফল বোঝাতেই এই নির্মম কাজটি করেছেন অবলীলায়। তো সে ঘটনার নেপথ্যে কি ছিল আর সেই অচেনা বিজ্ঞানী টেসলাই বা কে তারই আদ্যোপান্ত জানব আজ। আর হ্যাঁ, এই লেখার শুরুতে যে বিজ্ঞানীর একগাদা কাজের কথা পড়ে ফেলেছেন তিনিই নিকোলা টেসলা!

নিকোলা টেসলা জন্মেছিলেন ১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই সার্বিয়ায়। কিন্তু পুরো শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ক্রোয়েশিয়ায়। টেসলার বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।


১৮৬১ তে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন টেসলা। সেখানে জার্মান ভাষা, গণিত আর ধর্মতত্ত্ব শেখেন তিনি। ১৮৭০ সালে হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। স্কুলে চলছে গণিতের ক্লাস। টপিক ক্যালকুলাসের ইন্টিগ্রেশন । তো সেদিন কঠিন সব অঙ্ক দিয়ে শিক্ষক দেখছেন সবাই অঙ্ক করছে কিনা। সবাই গণিতে মগ্ন কিন্তু তারমধ্যে চুপচাপ বসে আছেন টেসলা। শিক্ষক কারণ জিজ্ঞাসা করা মাত্রই বোর্ডের সব অংকের উত্তর একে একে বলে দিলেন টেসলা। একবারো খাতা কলম হাতে নিলেন না। তো শিক্ষক ভাবলেন টেসলা হয়ত উত্তর মুখস্ত করে এসেছে । তিনি বানিয়ে দিলেন আরো কয়েকটা। এবারো খাতা কলমের দ্বারস্থ না হয়ে টেসলা সবগুলোর উত্তর নির্ভুলভাবে বলে দিলেন। শিক্ষক বুঝলেন এই ছেলে অসম্ভব মেধাবী ।

১৮৮০ সালে টেসলা পকেটে মাত্র চার পেনি নিয়ে আমেরিকায় পা রাখেন। ১৮৮১ সালে তিনি একটি টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে প্রথম সায়েন্টিফিক কাজ করেন। ১৮৮৪ সালের দিকে নিউইয়র্কে টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানিতে কাজ কতে যান টেসলা। সেখানে টেসলাকে প্রথমে সাধারণ ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজগুলো করতে দেয়া হয়।


এরপর তাঁকে দেয়া হয় ডিসি জেনারেটরকে পুনরায় ডিজাইন করার কাজ। পরের বছর টেসলা জানান তিনি এর চাইতে উন্নত কাজ করে দেখাতে পারবেন। উন্নত কিছু করে দেখালে এডিসন তাঁকে ৫০ হাজার ডলারের প্রতিশ্রুতি দেন। মাসের পর মাস কাজ করে টেসলা আসলেই কাজটা করে দেখান এবং এডিসনকে পেমেন্ট দিতে বলেন। তখন এডিসন তাঁকে হাসিমুখে শোনান, “আরে টেসলা, তুমি দেখি আমেরিকান হিউমারই বোঝোনা”। এডিসন টেসলার সাপ্তাহিক বেতন কেবল ১৮ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৮ ডলার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা নিতে আস্বীকৃতি জানান টেসলা। ছেড়ে দেন এডিসনের কোম্পানি।

১৮৮৬ সালে টেসলা ‘টেসলা ইলেক্ট্রিক লাইট এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি ডায়নামো ইলেক্ট্রিক মেশিন কমুটেটর বানান, যেটা ছিল তাঁর প্রথম পেটেন্ট। কিন্তু টেসলার নিত্য নতুন জিনিসে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ পেতনা। ফলে এক সময় টেসলা হয়ে পরেন কাজশূন্য। এক পর্যায়ে তাঁর পেটেন্টগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। আর নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগে যন্ত্রপাতি মেরামত করার কাজ করে বেড়ান টেসলা, এমনকি দুই ডলারের বিনিময়ে গর্ত খোড়ার কাজও করেন।


১৮৮৭ সালে টেসলা দুজন ব্যবসায়ীর সাথে মিলে একটা কোম্পানি খোলেন। সেখানে প্রথমবারের মত তিনি এসি কারেন্ট দিয়ে চলা ইন্ডাকশন মোটরের সফল পরীক্ষা চালান। ১৮৮৮ সালে IEEE তে এসি কারেন্ট তথা তারের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এমন বিদ্যুৎ প্রদর্শন করেন টেসলা। সবাই ব্যাপারটায় একেবারে অবাক ও মুগ্ধ হন। এমনকি ৬ হাজার ডলারের অফারও পেয়ে যান টেসলা। কিন্তু এতে হিংসায় পোড়ে এডিসন। এডিসন এসি কারেন্টের নাম দেন ‘ডেথ কারেন্ট’। আর নিউইয়র্কের রাস্তায় কুকুর বিড়ালের গায়ে কারেন্টের শক দিয়ে মানুষজনকে বোঝাতেন কতটা বিপজ্জনক এই জিনিস।

এডিসনের এই চক্রান্ত শেষতক কাজে দেয়নি। ১৮৯৪ সালে অদৃশ্য তরঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু করেন টেসলা। কিন্তু সেটার পেটেন্ট নেননি। পরের বছর উইলিয়াম রন্টজেন তা নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং নাম দেন এক্স-রে। আর সে বছরই টেসলার ল্যাবে আগুন ধরে প্রায় ৫০ হাজার ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেখাতে পারেননি এক্স-রের কাজ। নইলে প্রথম টেসলাই এক্স-রের মাধ্যমে ফটো তোলার কাজটি দেখিয়েছেন।


রবার্ট ওয়াটসনের ভাগে রাডার আবিষ্কারের কৃতিত্ব গিয়েছিল বলেই জানে সবাই। সে অবশ্য ১৯৩৫ সালে । অথচ তারও ১৫ বছর আগে এ নিয়ে তত্ত্ব দিয়ে যান টেসলা। ইউএস নেভিকে রাডারের টেকনোলজি নিয়ে প্রস্তাব দিতেও গিয়েছিলেন তিনি । কিন্তু ইউএস নেভির রিসার্চ ডেভেলপমেন্টের প্রধান ছিলেন এডিসন। ফলে টেসলার নামটি শোনা মাত্রই তা বাতিল করেন তিনি। তাই এনিয়ে আর কাজও করা হয়নি টেসলার।

এছাড়া নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়েও ধারণা দেন টেসলা। টেসলার ঝুড়িতে ট্রানজিস্টর বানানোর পেটেন্টও ছিল, যা ছাড়া কিনা আজকের কম্পিউটার তৈরিই হতনা।


আজকের বৈদ্যুতিক জেনারেটর- যার মূলনীতি মাইকেল ফ্যারাডের হলেও ব্যবহারিক আবিষ্কার ছিল নিকোলা টেসলারই। রিমোট কন্ট্রোল, রেডিওর তড়িৎ চুম্বকের ব্যবহার হতে শুরু করে ফ্লোরোসেন্ট বাতি যা কিনা সর্বসাধারণের কাছে টিউব লাইট হিসেবে পরিচিত সবই টেসলারই কৃতিত্ব। অবশ্য ফ্লোরোসেন্ট লাইটের কৃতিত্ব পুরোটাই গেছে এডিসনের দিকে। আর বিদ্যুৎকে মানুষের নিকট সহজলভ্য করে তোলার কথাতো আগেই বলা হয়েছে।


টেসলা বলে গেছেন “এমন এক সময় আসবে যখন সংবাদ, প্রেসিডেন্টের ভাষণ, কিংবা মাঠের খেলাগুলো তারবিহীন পদ্ধতিতে ঘরে বসেই দেখা যাবে”। আর বর্তমানে হচ্ছেও তাই ।


১৮৯৮ সালে তারবিহীন প্রযুক্তি দিয়ে একটি নৌকা দূর থেকে চালিয়েছিলেন টেসলা। লোকজন প্রথমবার তা দেখে যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। জাদু/টেলিপ্যাথির কারসাজি এমনটা মনে করেছিল মানুষ।

সারাজীবন বিজ্ঞানের উৎকর্ষে কাজ করে যাওয়া টেসলার শেষ কাজ ছিল মানুষের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎকে সহজলভ্য করা। এজন্য কয়েকটি কোম্পানির সাথে চুক্তি করে তারবিহীন বিদ্যুতের টাওয়ার বানানোর কাজে নামেন তিনি। কোম্পানিগুলো ভেবে বসেছিল টেসলা হয়ত রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে কাজ করছে তাই তারা সহজেই বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটি মানবকল্যাণমুখী কাজের প্রকল্প এবং এ থেকে তাদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই জানতে পেরে তারা অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয়।


১৯৪৩ সালের ৬ জানুয়ারিতে টেসলা সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় একাকী নিউইয়র্কের এক হোটেল রুমে মারা যান। সারাজীবন বিয়ে না করা এই মানুষটা অনর্গল কথা বলতে পারতেন ৮ টি ভাষায়। আর একবার যেকোনো বই পড়লে সেটা তার মগজে পুরো গেঁথে যেত। টেসলার মৃত্যুর পর এফবিআই তার সকল কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে ফেলে।


৩০০ এর অধিক পেটেন্ট আছে টেসলার নামে। আর বর্তমানে তারই আবিষ্কার করা প্রযুক্তিকে একটু এদিক-সেদিক করেই নতুন নতুন সব জিনিস আনছে বিজ্ঞানীরা। তার মৃত্যুর ৮০ বছর পার হওয়ার পর এখনকার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন টেসলার বলে যাওয়া তারবিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রযুক্তি অনেকটা দ্বারপ্রান্তে।


একজীবনে মানবজাতিকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন টেসলা। এককভাবে এত বেশি প্রযুক্তি আবিষ্কারের কৃতিত্ব আর কেউ এখন অব্দি দেখিয়ে যেতে পারেননি। পরিতাপের বিষয় এই যে, এত এত মৌলিক চিন্তাধারা আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া মানুষটা বেচে থাকাকালীন তেমন একটা সম্মান পাননি। অথচ আমাদের দিয়ে গেছেন দুহাত ভরে। নতুন প্রজন্ম জানেইনা কতটা অসাধারণ ছিলেন নিকোলা টেসলা আর তার অনন্য কাজগুলো।

তার সম্মানে ম্যাগনেটিক ফ্লাক্স ইন্টেনসিটির এস আই একক ‘টেসলা’। স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক টেসলার প্রতি সন্মান জানিয়েই তাঁর কোম্পানির বানানো বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির নাম রেখেছে ‘টেসলা’। প্রতি বছর জুলাইয়ের ১০ তারিখ পালন করা হয় টেসলা দিবস হিসেবে।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.